মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনে অপহৃত হবার পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা দলের কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্নেল এ. কে. এম সুফিউল আনাম প্রায় দেড় বছর পর মুক্তি পেয়ে বুধবার বাংলাদেশে ফিরেছেন।
আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার বিরুদ্ধে আনামসহ ইয়েমেনের চার নাগরিককে অপহরণ করার অভিযোগ রয়েছে। তবে কীভাবে তিনি মুক্তি পেলেন সে বিষয়ে জাতিসংঘ, বাংলাদেশ সরকার বা ভুক্তভোগী সেনা কর্মকর্তা কোনও তথ্য দেননি।
বুধবার সন্ধ্যায় বিমানবন্দরে সুফিউল আনাম পৌঁছালে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়। তিনিও হাত উঁচু করে স্বজন, সুহৃদসহ অন্যদের হাসিমুখে শুভেচ্ছা জানান।
সাংবাদিকদের তিনি জানান, ইয়েমেনের মরুভূমিতে ও পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে ১৮ বার জায়গা পরিবর্তন করে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল।
মুক্তির পর সংযুক্ত আরব আমিরাতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে তিনি দেশে ফেরেন। এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন আনাম। গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই-এর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানান তিনি।
আনাম বলেন, “আমি কখনও ভাবিনি অপহরণের পর ফিরে আসতে পারব। দেড় বছরের কষ্ট বলে বোঝানো যাবে না।”
ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, “পেশাগত কাজ শেষে গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি আমরা ছয়জন বন্দরনগরী এডেনে ফিরছিলাম। আমার সাথে দুটি গাড়ি ছিল। রাস্তার মাঝখানে অস্ত্রের মুখে গাড়ি অবরোধ করা হয়। আমাদের অপহরণ করে পাহাড়ে নেওয়া হয়।”
“আমাদের ভাগ্য ভালো তারা আমাদের নির্যাতন করেনি অথবা দুর্ব্যবহার করেনি,” জানিয়ে কর্নেল আনাম বলেন, “জাতিসংঘের কাছে আল-কায়েদার দাবি-দাওয়া পূরণের জন্য আমাদের অপহরণ করা হয়।”
“যা হয়েছে তা সাধারণত সিনেমা-মুভিতে দেখা যায়। আমি আকাশ-বাতাস দেখতে পাইনি মাসের পর মাস,” যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই-এর পরিচালক ইমরুল মাবুদ বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, কর্নেল আনামকে মুক্ত করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। আল-কায়েদা অপহরণের পর ত্রিশ লাখ মার্কিন ডলার মুক্তিপণ চেয়েছিল।”
“আমরা কোনো টাকা পরিশোধ ছাড়াই তাঁকে মুক্ত করেছি। এটি সম্ভব হয়েছে বিভিন্ন দেশ ও দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সাথে ভালো সম্পর্কের কারণে,” বলেন ইমরুল।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল আনাম গৃহযুদ্ধপীড়িত মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনে জাতিসংঘের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন।
ঘটনার সময় তিনিসহ আরও চার ইয়েমেনি নাগরিককে অপহরণ করেছিল আল-কায়েদা ইন অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা (আকাপ)।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, তাঁদের মুক্তির জন্য ইয়েমেন সরকারের হাতে আটক সন্ত্রাসীদের মুক্তি এবং মুক্তিপণ দাবি করে আকাপ।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে কর্নেল আনামের একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করে আল-কায়েদা। ওই বার্তায় জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংগঠনগুলোকে আটককারীদের দাবি মেনে নিয়ে মুক্তির আবেদন জানান কর্নেল আনাম।
সর্বশেষ এ বছর জুন মাসে কর্নেল আনামের আরেকটি ভিডিও প্রকাশ করে আল-কায়েদার ইয়েমেন শাখা।
ওই ভিডিওতে আনাম বলেন, তিনি এবং তাঁর দুই সহকর্মী মারাত্মকভাবে অসুস্থ। তাঁদের জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা দরকার।
কী করেছে বাংলাদেশ সরকার
অপহরণের খবরটি আন্তর্জাতিক মহলে চাউর হলে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতিসংঘ এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে বিষয়টি নিয়ে মুক্তির সম্ভাব্য কৌশল নিয়ে আলোচনা করে।
তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা হয়।
কমিটির সভাপতি কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বুধবার বেনারকে বলেন, “কীভাবে তিনি মুক্তি পেলেন সেটি ব্যাপার নয়। উনি মুক্তি পেয়েছেন এটিই বড়ো কথা। এটি আমাদের জন্য সুখবর।”
তিনি বলেন, “কর্নেল আনাম মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে আমার ছাত্র ছিল। তাঁর অপহরণ আমাকে সত্যিই ব্যথিত করেছে।”
ফারুক খান বলেন, “কর্নেল আনাম বাংলাদেশ সরকারের নয়, জাতিসংঘের কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর মুক্তি আরও আগে হওয়া উচিত ছিল। তাঁকে মুক্ত করার মূল দায়িত্ব ছিল জাতিসংঘের।”
তিনি বলেন, “আমি মনে করি জাতিসংঘ যদি আরেকটু বেশি তৎপরতা দেখাত, তাহলে উনি আরও আগে মুক্তি পেতেন। তাঁর এতো কষ্ট হতো না।”
ইয়েমেন পরিস্থিতি
সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাশের দেশ ইয়েমেন। আরব বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এবং অনেকটা দুর্ভিক্ষ কবলিত দেশ এটি।
উত্তর আফ্রিকার কাছে ভারত মহাসাগরে অবস্থানের কারণে ইয়েমেন বৈশ্বিক শক্তির কাছে কৌশলগত স্থান। এই দেশ নিয়ে অটোমান অর্থাৎ তুর্কি এবং ব্রিটিশদের মধ্যে বিরোধ ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়ের ফলে অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে দেশটির উত্তরাঞ্চল উত্তর ইয়েমেন হিসাবে একটি পৃথক রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
তবে ভারত মহাসাগর ঘেঁষে থাকা দক্ষিণাঞ্চল ব্রিটেনের করদরাজ্য হিসাবে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনের ফলে সেখানে বিদ্রোহ শুরু হলে ১৯৬৭ সালে ব্রিটেন ইয়েমেন থেকে চলে যায়।
দক্ষিণ ইয়েমেনে কমিউনিস্ট আদলে সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন দুর্বল হয়ে পড়লে ১৯৯০ সালে উত্তর ইয়েমেন ও দক্ষিণ ইয়েমেন একত্রিত হয়ে ইয়েমেন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
তবে দেশটির জাতিগত সমস্যার সমাধান হয়নি।
শিয়া ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ২০১৪ সালে রাজধানী সানা দখল করে নিলে আবার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় পদত্যাগ করেন সুন্নি প্রেসিডেন্ট আবদ রাব্বু মনসুর হাদি এবং তিনি সৌদি আরবে পালিয়ে যান।
মনসুর হাদির পক্ষে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্বে হুতিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু হয়। সেখানে শুরু হয় সৌদি আরব ও ইরানের শক্তির পরীক্ষা।
এই যুদ্ধে অনেকটা পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে সৌদি জোট। যুদ্ধের ফলে নারী-শিশুসহ লাখ লাখ মানুষ অনাহারে রয়েছে।
জাতিসংঘের মতে, বিশ্বে সবচেয়ে বড়ো মানবিক বিপর্যয় হয়েছে ইয়েমেনে। তবে এই বছর চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে ইয়েমেনে সংঘাত কমেছে।
সূত্র: বেনার নিউজ